রূপকুন্ডের রহস্য – “Skeleton Lake”

0

সোমাদ্রি সাহা

আমি ছোটবেলায় যখন ঘুমাতে যেতাম একটা ভয় কাজ করত। এই বুঝি আমায় কেউ উঁচু পাহাড় থেকে নিচের দিকে ফেলে দিল। কষ্ট হত খুব। ঘুম ভেঙে যেত। সময় বয়ে গেল স্রোতের নদীতে। অনেকবার হাওড়ার ব্রিজ টপকে বেরু বেরু করতেও গেলাম। কিন্তু পাহাড়কে জয় করার আকাঙ্খা দিনে দিনে বেড়ে গেল। একটি কাজের জন্য ওয়ালপেপার দেখতে গিয়ে অপূর্ব এক দৃশ্য চোখে এলো। জায়গাটির নাম আলী বুগিয়াল। অপূর্ব। নেট ঘেটে জানলাম ট্রেকিং করে যেতে হয় রূপকুন্ড। সেই পথেই এই স্থানটি। আর রূপকুন্ডে রয়েছে একটি লেক। যেখানে ১৯৪৩ সালে বনবিভাগের কর্মীরা কাজ করতে গিয়ে খুঁজে পায় অনেক মাথার খুলি, কঙ্কাল। যদিও কেন এত মানুষ ওখানে মারা গেলেন তার হদিস পাওয়া যায়নি। অনেক পাথরে, লোহার তৈরি হাতিয়ার তাদের কাছে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেন খুলিগুলোতে ভারী কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন। হতে পারে কোনও আদিম জনগোষ্ঠী এখানে ছিল। আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মারা যান। তবু এই স্থানটির একটা চুম্বকীয় টান আছে। হতে পারে আমিও হারিয়ে যাব। হতে পারে আমিও এই রূপকন্ডে হয়ে যাব কঙ্কাল তবু আমায় এই ট্রেকিং-এ যেতেই হবে। এখানে না গেলে আমার এ জন্মই বৃথা। আমার স্বপ্নের সেই পাহাড় যে বাস্তবে আছে, কেউ যে আমায় ফেলে দিচ্ছে সেটাই চাক্ষুস দেখতে হবে। হয়তো ঐ কঙ্কালের মধ্যে আমিও ছিলাম কোনও এক জন্মে। আবার ফিরে এসেছি এজন্মে এক রিপোর্টার হয়ে। আমি নিজেও জানি না। অনেক কষ্ট করে ছুটির আবেদন করেও যখন কর্তৃপক্ষ পুজোর আগে ছুটি দিতে চাইল না, তখন না বলেই হাতে যেটুকু সম্বল ছিল নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম।

আসলে যে কথাটি বলা হয়নি, তা হল এই রূপকুন্ডে ট্রেকিং-এর সব থেকে ভাল সময় হল মে মাসের শেষ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। তাই এই সময়টা গেলেই ট্রেকিং-এর অন্যান্য দলের সঙ্গে আপনিও যেতে পারবেন। তবে আমি রাগ জেদ করে একাই বেরিয়ে যাই। প্রথমে দিল্লি। তারপর রানিক্ষেত্র এক্সপ্রেস-এ কাঠগোদাম। সেখান থেকে লোহাজঙ। তবে আপনারা দেরাদুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বার নেমে সেখান থেকেও লোহাজঙ পৌঁছাতে পারেন। আমি কাঠগোদাম হয়ে লোহাজঙের পথটি ধরেছিলাম।

তাহলে কিভাবে যাবেন – কলকাতার হাওড়া থেকে ট্রেনে হরিদ্বার বা হলদোয়ানি / কাঠগোদাম গিয়ে ভাড়ার গাড়ি বা বাস / জীপে করে কর্ণপ্রয়াগ / থারালি হয়ে লোহাজঙ / ওয়ান। তারপর ৫/৭ দিনের ৭০ কিমি ট্রেক।

স্থানীয় ব্যবস্থা – লোহাজঙ / ওয়ান এ গাইডরাই সব ব্যবস্থা করে দেবে।

আনুমানিক খরচ – গাইড ৮০০/-, ঘোড়া সহ পোর্টার ৫০০/-, রান্নার সরঞ্জাম ৩০০/-, টেন্ট ২০০/- দৈনিক। পারমিট ৫০০/-। ৪ জনের দলের কলকাতা থেকে জনপ্রতি খরচ ১২০০০/- । তবে খরচ কিছুটা বদলে যায় মরসুমের ভিড় কেমন তার উপর নির্ভর করে।

লোহাজঙ

আট হাজার ফিটের উপর লোহাজঙ স্থানটি বেশ শীতল ও মনোরম। মনে শান্তি আসে। শরীরটা শান্তিময় হয়ে যায়। আমাদের যিনি নিয়ে যাবে রূপকুন্ডে তার নাম সিংজী। তিনি তখন একটু দূরে দেবল-এ ছিলেন। তার সাথে কথা হল। এখান থেকে রূপকুন্ড ট্রেক-এর সমস্ত ব্যবস্থা ওঁনারাই করে দেন। তাদের আস্তানাতেই রাত কাটালাম। পরের দিন সকালে সিংজি এসে ঘুম ভাঙালো। অনেকটা পথের জার্নি করে শরীরটা কেমন যেন করছিল। তবু রূপকুন্ডের টানে জেগে উঠলাম। এখানে এরা একটু অসুবিধা দেখায়। কে নিয়ে যাবে এটা দেখিয়ে একটু বেশি টাকা রোজগার করে নিতে চায়। তবু ঘোড় সহ পোর্টার পাওয়া গেল। সিংজি রান্নার জিনিস জোগাড় করে নিয়ে আসল। স্থানীয় দোকান থেকেই এখানে সব রসদ পাওয়া যায়। কেরোসিন নেই। তাই সামনের এক গমকল থেকে ডিজেল নেওয়া হল।

লোহাজঙ-এ ট্রেকিং এর জন্য দরকারী সবকিছুই কিনতে পাবেন বা ভাড়ায় পাবেন। আরও উপরে উঠলে টেন্ট মিলবে। এখান থেকে নিলাম না। ঠাণ্ডায় আজই স্নান করে নিলাম গরম জলে। এরপর কয়েকদিন তো স্নান হবে না, বরফের বাসিন্দা হতে হবে। আলুপরটা আর চা খেয়ে যাত্রা শুরু করতে সাড়ে দশটা হল। এখন আরও কিছু লোক আমার সাথেই যাবে। আমাদের পথ এখন দিদিনা, দূরত্ব প্রায় ৭ কিমি। যদিও অনেকেই গাড়িতে চলে যান ওয়ান নামক স্থানে। সেখান থেকেই ট্রেক শুরু করে।

আমরা নিচের দিকে নামতে থাকলাম। ঘোড়া বয়ে নিয়ে চলেছে রুকস্যাক। এখানে একটু সাবধানতা প্রয়োজন। নামার সময় চটজলদি করতে গেলে পায়ে লেগে যাবে। একেই মাসেল ক্রাম্পের ভয় রয়েছে। আমরা তো আর এই পরিবেশে অভ্যস্ত নই। এরপরের দিকে আড়াই ঘণ্টার উৎরাই বেশ কষ্টের। আসলে হাফ ধরে যায়। যদিও ওক-পাইন-রডডেনড্রনের জঙ্গলে ঘেরা এই পাহাড় খুবই সুন্দর। একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম ও নীলগঙ্গা নদী পার হয়ে এবার একটা মারাত্মক একটি চড়াইয়ের পথ ধরলাম। তার মধ্যে সামান্য বৃষ্টিও হয়ে গেল। রাস্তায় কিছু জনপদের সাথে দেখা হল। মোটামুটি বিকেল চারটের সময় দিদিনায় পৌঁছালাম। তুলি ক্যানভাসে রঙ করা মাটি-পাথরের দোতলা বাড়িতে আশ্রয় নিলাম আজ। হোম-স্টে আমাদের ট্রেকিং-এর পথে স্বর্গের মতো লাগে।

দিদিনা

এই স্থানটি মোটামুটি ৮০০০ ফিট, ঠান্ডাও একই রকম হাল্কা। এখানের কাঠের উনুন। সেখানে চা থেকে খিঁচুড়ি সবই হল। এখানে আরও কিছু বাঙালির সাথেই দেখা হয়ে গেল। আড্ডার সাথে রাতে ডিমের ঝোল ও ভাত। সিংজি কোথা থেকে পিঁয়াজ আর শসা নিয়ে এলেন। স্যালাডও মন্দ হল না। লেবুটা পেলাম না।

পরের দিন ভোরবেলায় গাইড-পোর্টার রান্না করতে চাইছিলেন না। আমাদের খাটিয়ে নিতে চাইছিল। তবু খিচুড়ি রান্না হল। সকাল নটায় যাত্রা শুরু হল। এবারে শুকনো পাতার মধ্যে দিয়েই কঠিন চড়াই। পোর্টার বলল টোলাপানি দিয়ে উঠলে চড়াই কম হত। এখন আর বলে কী হবে, চার ঘন্টা লাগল খুপাল টপ-এ পৌঁছাতে। এই স্থানটির থেকেই শুরু আলি বুগিয়ালের।

আলি বুগিয়াল

বিস্তীর্ণ বুগিয়ালের সবুজ এলাকা। সেই কম্পিউটারের ডেস্কটপের ছবি। এখন আমার নিজের চোখের সামনে। বেশ সুন্দর স্থানটি। এখানে তেমন বসতি নেই। আমরা কয়েকজন এখানেই একটু ছাতু মেখে খেলাম। আসলে স্থানটি এমনই এক মেঘবালিকার খেলাঘর যদি আকাশ পরিস্কার থাকে অনেক তুষারশৃঙ্গ দেখা যায়। আরও ঘণ্টা দুয়েক হেঁটে দেখা পেলাম আরও এক বিখ্যাত বেদিনীবুগিয়ালের।

বেদিনী বুগিয়াল

প্রায় ৭ ঘণ্টায় আমরা ১২ কিমি পথ ট্রেক করে বেদিনী বুগিয়ালের ক্যাম্পে পৌঁছলাম। তখন বিকেল ৪ টে বেজে গেছে। এখানকার উচ্চতা প্রায় ১২০০০ ফুট। এখান থেকে সোনালি রোদের মধ্যে দিয়ে কিচু দূরেই ত্রিশূল, নন্দাঘুন্টি দেখতে পেলাম। যদিও ক্যামেরা ভিউফান্ডারে কিছুটা, তবু অনেকটাই দূরত্ব। এখানে ফরেস্টের ৫ টি হাট ও একটি ঝুপড়িও দেখতে পেলাম, যারা থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছাড়াও ফোন করার সুবিধাও রেখেছিল। একটি টেন্টে আমাদের আজকের আশ্রয়। আমরা রোদের উপর সবুজ ঘাসের কার্পেটেই চা-মুড়ি বাদাম পেটস্থ করলাম। এখানে দেখলাম একটু দল রূপকুণ্ড যেতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে ফিরলেন। এখানে একটা হাটকে রান্নাঘর করে নিয়েছে, আমরাও সেখানে আমাদের জিনিসেই ডিমের ঝোল ভাত বানালাম। এখানে যারা ছিল তাদের সাথেই ক্যাম্প ফায়ারেও যোগ দিলাম। বেশ ঠান্ডা নামল রাতে। টেন্টের মধ্যেও বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। আমাদের স্লীপিং ব্যাগও মনে হয় এই অধিক উচ্চতার ঠান্ডার জন্য উপযুক্ত ছিল না, আসলে আগেই বলেছি উচ্চতা ও পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় সময় আমি নিয়ে আসিনি।


সকালে ওভারকাস্ট আবহাওয়া। সিংজি ম্যানেজ করে অন্যদের সাথেই ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থাটা করে দিল। এখানে আজ তেল চপচপে পুরী-সব্জি হয়েছিল। এইসব খেয়ে পেটরোগার এতটা পথ যাওয়া চাপের। ফরেস্ট গার্ড এসে ৫00 টাকার রসিদ দিল, আলাদা করে টেন্টের জন্য আর কিছু চাইল না। আজ সকাল ৭টায় রওনা দিলাম। আমারা কয়েকজন বেদিনী কুণ্ডের পাশের ছোট্ট মন্দিরে পুজো দিলাম। বর্ষার পর কুণ্ডে যখন জল থাকে তখন নন্দাঘুন্টি আর ত্রিশূলের অসাধারণ প্রতিফলন আমার এই জন্মটা স্বার্থক করে দিল। আমি অপদার্থ হতে পারি কিন্তু এই দৃশ্য টাটা বিড়লা ট্রেক করে এসেও দেখতে পাবে বলে মনে হয় না। ঐ দূরে পাহাড়ের খাঁজে সেই যে রাস্তাটা মিলিয়ে যায় সেটাই ঘোড়ালোটানি। আমরা সামান্য চড়াই ভেঙ্গে সেখানে পৌঁছালাম। এরপর সহজ লম্বা পথ পাথরনাচুনি পর্যন্ত যেতে হল। আমরা বিশ্রাম নিতে নিতেই এগোচ্ছিলাম। অভ্যস্ত নই। তাই লাঠিতে ভর দিয়ে নিজেদের অক্সিজেনটা নিয়ে নিচ্ছিলাম। তিন চারজন বিদেশী দম্পতি বিন্দাস আমাদের ওভারটেক করে চলে গেল। আসলে মিস্টার আমি যে ভেতো। সেটা বুঝলাম।

পাথরনাচুনিতে ফরেস্ট হাট রয়েছে, বেদিনীর মত একটা ঝুপড়িও আছে। এখান থেকে দেখা যায় সামনের পাহাড়ের মাথায় কলু বিনায়ক। কঠিন চড়াই। গণেশ দাদান বলে কথা নিজের মনের ও হাঁটুতে জোর সঞ্চয় করে লড়াইটা শুরু করে দিলাম ! মাঝপথে ছাতু খাবার আছিলায় বেশ খানিকটা বিশ্রাম। পথের ধারে বরফ দেখে মনের মধ্যে কেমন যেন করতে লাগল। কলু বিনায়ক-এ ছোট্ট একটা মন্দির।

দূরের পাহাড়িয়া দৃশ্যরা দারুণ। এখান থেকে একটা সহজ পথ গিয়েছে বাগুয়াবাসা ক্যাম্পে। আমরাও এই পথে মাঝেমধ্যেই বরফে ঢাকা পেলাম। বরফে হাঁটা একটু সমস্যার তো বটেই। প্রায় ৯ কিমি পথ আমরা কয়েকজন ৯ ঘণ্টায় ট্রেক করে বিকাল ৪ টে নাগাদ পৌঁছলাম।

বাগুয়াবাসা

বাগুয়াবাসার উচ্চতা প্রায় ১৪০০০ ফুট। আবহাওয়া মেঘলা, তবুও ঠাণ্ডাটা ভালই লাগছিল। এরটি নাম করা সংস্থার টেন্টেই আজকের আশ্রয়। এখানে ফরেস্টের দুটি হাট রয়েছে। একটি দল আবার দেখলাম ব্যর্থ হয়ে ফিরল। বুঝতেই পারলাম আমারও মনে হয় স্কেলেটন লেক দেখা হবে না। আগের দলটি প্রাণ নিয়ে কোনও রকমে ফিরল। দূরে দেখতে পেলাম চার জন নামছে। আসলে বরফে আছাড় খেতে হয়। কয়েকজন পুরো ভিজে গেছে। এই ঠান্ডায় পুরো কাঁপুনি দেয়। তারপরে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কে জানে আমাদের এরপর কী হবে। আসলে আবহাওয়া বদলে গেছে। এখানে ঠান্ডা বেড়েছে। মনের মধ্যে সেই রবি ঠাকুর বলতে লাগল – বিপদে মোরে রক্ষা করো…একলা চলো রে। যেতে আমাকে হবেই। মরার আগে আমি মরব না। এটাই অপদার্থের প্রতিজ্ঞা। বিদেশী একজন ভদ্রলোক আমায় বাঁশি শোনাল। এই ঠান্ডাতেও মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখছে এটাই পাওয়ার। বিদেশি ভদ্রলোক নাকি ইস্কনের ভক্ত তাই বাংলাও জানেন। কী কেলো, ওদের ভেঙিয়ে কত কিছু বলেছি, সবই বুঝেছে। সর্বনাশ। সারা রাত টেন্টের বাইরে তুষার চুমু দিয়ে গেছে।

ভোরে উঠে রেডি হলাম। পেটে খাবার দিয়ে শরীর মটরকে চাঙা করে নিলাম। ভোর পাঁচটায় যাত্রা শুরু করলাম। আজ জুতোতে ক্রাম্পন লাগিয়ে নিলাম। গাইডের কাছে অনেক সরঞ্জাম রইল। মোট সাত জন একসাথে চলেছি। যা হবে দেখা যাবে, লড়কে লেঙ্গে স্কেলেটন। পুরো পথটাই প্রায় চড়াই আর বরফে ঢাকা, তাই বেশ কঠিন। মাসখানেক পরে বরফ গলে যাবার পর আবার ততটাই সহজ। তখন এই পথেই ব্রহ্মকমল, হেমকমল ইত্যাদি অধিক উচ্চতার পাহাড়ি ফুলগুলো সুন্দর ভাবে দেখতে পাওয়া যায়। গাইড পথ বানাচ্ছিল বরফ কেটে। আমরা সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করছিলাম। শুরু থেকেই আমি পিছিয়ে গেছিলাম। উচ্চতা ও বরফের ভয় মনেতে। এর আগে বরফের উপরে বিনোদনের মতো হাঁটা হয়েছে। এখানে নিচে টপকে গেলে ইতি। মাঝপথে সহ সাথীর কোকা-৩০ একডোজ খেতে বাধ্য হলাম। এমন ঠান্ডায় একমাত্র ইয়েতি বেঁচে থাকতে পারে। মোটামুটি ৭-৩০টায় আমরা প্রায় একসাথেই রূপকুন্ডের মন্দিরে পৌঁছলাম। উচ্চতা প্রায় ১৬০০০ ফুট। চারিদিকে এদিক সেদিকে বরফের ঢালে ঘেরা বরফাবৃত রূপকুণ্ড। মনের মধ্যে এমন একটা হচ্ছিল যে পাগলের মতো লাগছিল। এভারেস্ট তো জয় করতে পারব না। এই মুহূর্তই সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে রয়ে গেল। অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অনেকেই ষস্টাঙ্গে মন্দিরের সামনের বরফে শুয়ে পড়ল। এখানেও পুজো দেওয়া হল! রূপকুণ্ড বা মিস্ট্রী লেকের গল্পটা গাইডই নতুন করে বলল। পাওয়া গেছিল অনেক আগে বন বিভাগে কর্মচারীদের কথা মতো কঙ্কাল। সেই কঙ্কালের লেক নিচেই রয়েছে। অনেকে সেই সব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি ঐ কঙ্কালের ইতিহাস, কে সেই সব করেছে, কেনই বা মেরেছিল তিনশো জন মানুষকে সে সব বুঝলাম না। হতে পারে পুরোটাই মিথ। স্থানটিকে দর্শনীয় করতেই হয়তো…আবার মনে হল এখানে হয়তো এক যুগে জনবসতি ছিল। আবহাওয়া বদলের সাথে সাথেই নানা ভাবে মানুষ মারা যায়। তবু গাইড যখন বলল খুলিতে আঘাত, তখন বুঝলাম হয়তো কোনও জনগোষ্ঠীর মারপিট হয়েছিল। তাই জন্য এমন হয়েছে।

কাল সারারাত বরফের পরে আজকের আবহাওয়া দারুন সুন্দর। আমরা ঠিক করলাম জোনারগলি পাসেও উঠব। এক ঘণ্টায় পৌঁছেও গেলাম। উচ্চতা প্রায় ১৭০০০ ফুট। চারিদিকে ধবধবে সাদা বরফের উপরে দাঁড়িয়ে, নীলাকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ। স্বর্গ এই পৃথিবীতেই রয়েছে! এমন স্থানে তো মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করেই পৌঁছালাম। মনে হচ্ছে দুই পা দিলেই নন্দাঘুন্টি আর ত্রিশূল। এই শৈলসমুদ্র পার করেই দুই পর্বতের মধ্যে দিয়েই হোমকুণ্ড আর রন্টি স্যাডল যাবার পথ। যদিও সেখানে যেতে গেলে অগস্টের পর আসতে হবে। আমার ছাতুমাখা আর ওদের আপেল ভাগ করে খাওয়া হল। এবার স্বর্গ থেকে বাস্তবে নেমে আসার কঠিন বাস্তবতা বাঙালি আমি! বরফের রাজ্য থেকে কর্কশ পাথুরে কলকাতায় ফিরে আসা। তবুও নামার সময়েও সাবধানের ত্রুটি রাখিনি। আমি অনেক দেরিতে ধীরে ধীরে সবার শেষে বাগুয়াবাসায় ফিরলাম ১০ কিমি পথ ৭ ঘণ্টায় হাঁটার পরে দুপুর ১২টায় ফিরলাম।

তারপরে একই পথে ব্যাক করলাম লোহাজঙ। যারা এখন যাচ্ছেন তাদের উৎসাহ দিতে থাকলাম। মনে মনে জানি এই পথ সত্যই মুক্তিযুদ্ধের মতোই কঠিন। এই পথ জীবনের বেঁচে থাকার মতোই কঠিন। তুষারপাত, ঠান্ডা, হাওয়া, বরফে আছাড় খাওয়া। প্রচন্ড বাস্তবতা তবু মানুষকে উৎসাহিত তো করতেই হবে। মানুষই তো পারে সমস্ত বাঁধা পেরিয়ে প্রকৃতিকে জয় করতে। সেই পথ ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কাঠগুদাম থেকে একটু দূরেই হলদিওয়ানি স্টেশনে এসে আর দেখতে পেলাম না পাহাড়। ফিরে তাকালাম আকাশের মেঘের দিকে। চিন্তে পারলাম। মেঘটাও আমায় দেখে হাসল। নাকে ভেসে এলো পাহাড়ি পথের গন্ধ। ঐ তো দূরে একটি পাহাড়ি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফুল নিয়ে…আচ্ছা ও কে, ও কী আমার ভালবাসার চেতনা, নাকি সত্যই এক নারী…কঙ্কালের লেকের মধ্যে তবে যে খুলি দেখলাম সেখানে কী তবে আমার পূর্বজন্ম ছিল, তাই কী আমি বরফের ঐ চূড়ায় আলাদা শক্তি পেয়ে গেলাম। ভাবতে ভাবতেই ট্রেনের মধ্যে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম বুঝতে পারিনি। টিটি ডাকছে, টিকিটটা দেখাবেন প্লিজ। আমি আমার ক্ষত পা কোনও রকম নামিয়ে বললাম এই তো টিকিট, বলে দেখিয়ে দিলাম স্কেলেটন লেকের ছবি…

Subscribe to my YouTube Channel

Leave a Reply

error: Content is protected !!